পর্যালোচনা

কাঠামোগত অর্থ ব্যবস্থা ‘জাতীয়’ হওয়া উচিত

অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান

মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের আক্রমণাত্মক মুদ্রা সংকোচনমূলক প্রচারণা বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ অর্থনীতি চাপে পড়েছে। মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে অন্যান্য মুদ্রার তীব্র মূল্যবৃদ্ধির ফলে অনেক উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণের ব্যাপক খরচ এবং ভোক্তামূল্য বৃদ্ধি দেখেছে। পরিস্থিতিতে সুদের হার বাড়ানো ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত ছাড়া স্থানীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে বিকল্প নেই।

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে কয়েকটি নিম্ন আয়ের দেশ ডলারের আধিপত্যে পিছিয়ে পড়েছে। তবে অভিযোগ না করে নীতিনির্ধারকদের আন্তঃসীমান্ত পুঁজিপ্রবাহে বিদ্রুপাত্মক ভাব দেখিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার দূরে রাখার কথা বিবেচনা করা উচিত। প্রতিকূল আর্থিকনীতির বাড়তি প্রভাব কমাতে বিশ্বের কাঠামোগত আর্থিক অবিশ্বায়নে এখন একটি লড়াই প্রয়োজন।

২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর ফেডারেল যখন পরিমাণগত সহজকরণ কর্মসূচি চালু করেছিল, তখন উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে ফটকামূলক পুঁজিপ্রবাহকে উৎসাহিত এবং বিপজ্জনক সম্পদে তেল ঢালার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। এখন ফেডারেল নিজ দেশেই ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সুদের হার বাড়াচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, নিজেদের মুদ্রাস্ফীতি আর্থিক অস্থিতিশীলতা কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র পুঁজি ফিরিয়ে আনতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে কাজ করেছে বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) গরিব দেশগুলোকে ভিখারির চোখে দেখে এবং তাদের নীতি গ্রহণে বাধ্য করে।

ফেডারেলের নীতির কারণে সমালোচনা করা হয়, যাতে ফেডারেল আর্থিক নীতি সহজ করে। আর যদি নীতি কঠোর করে তাহলে অভিশাপ দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সারা বিশ্বের দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে পুঁজিপ্রবাহের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং নিজেদের শুধু মার্কিন মুদ্রানীতির কাছে নয়, বরং বিদেশী অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেছে নিয়েছে। কোনো কোনো দেশের নেতা ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রায়ই দেশীয় এলিট স্বার্থে স্বেচ্ছায় নিজেদের অরক্ষিত করেন।

উদীয়মান অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা মুদ্রানীতির আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী আচরণ বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন এবং মার্কিন প্রতিপক্ষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। তবে যারা আর্থিক নীতি সমন্বয়ের আশা করছেন, তারা কভিড-১৯ এর শিক্ষা উপেক্ষা করছেন বলে মনে হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের সতর্ক করে জানিয়েছিলেন, মহামারী শেষ করার একমাত্র উপায় ছিল বিশ্বের বেশির ভাগ জনসংখ্যার টিকা প্রয়োগ নিশ্চিত করা, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অন্য ধনী দেশগুলো সেটি আমলে না নিয়ে নিজেরাই পরবর্তী সময়ে বেশি টিকা মজুদ করেছে, যা টিকা বৈষম্যে রূপ নিয়েছিল এবং দরিদ্র দেশগুলোকে টিকাদানে জোর দেয়া হয়েছিল।

একইভাবে বিশ্বব্যাপী আর্থিক নীতির সমন্বয় চাওয়া বোকামি মনে হচ্ছে। বিশ্ব এখন বহুপাক্ষিকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা কয়েক দশক ধরে নিবিড় পরিচর্যায় (আইসিইউ) রয়েছে। শুধু মার্কিন বাণিজ্য বাধা নয়, ক্রমবর্ধমান চীন-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থনৈতিক বিভাজন ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে একটি নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

তাহলে ডলারের আধিপত্যের বিকল্প কী? উদীয়মান বাজার নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই আর্থিক বিশ্বায়নের লোভমুক্ত হতে হবে। হার্ভার্ডের ড্যানি রড্রিক আমার করাসহ বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ব্যক্তিগত পুঁজির আন্তঃসীমান্ত প্রবাহ টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায় না। আর্থিক বিশ্বায়নের মূল সুবিধাগুলো যদি থাকে, তাহলে হঠাৎ মন্দা, পুঁজির ঊর্ধ্বগতি বা নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষতি সামলে নেয়া যায়। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনে চীনের নীতিগুলো খারাপ হলেও চীন এখনো বর্তমান আর্থিক অস্থিরতার মধ্যে নিজস্ব নীতি ব্যবহার করতে সক্ষম।

উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের দুর্দশার গল্প ছেড়ে দিতে হবে এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার বিভ্রম ত্যাগ করতে হবে। এর পরিবর্তে নীতিনির্ধারকদের ব্রেটন উডস যুগের নীতি গ্রহণ করে পুঁজির গতিশীলতা ফিরিয়ে এনে আর্থিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে হবে। সেজন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আন্তরিক সহযোগিতার আশা ছাড়তে হবে। উন্নয়নশীল উদীয়মান বাজারের দেশগুলোকে অবশ্যই আন্তঃসীমান্ত পুঁজিপ্রবাহে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে হবে, বিশেষ করে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশগুলোকে।

শুধু ভালো পুঁজি, যেমন বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যা প্রাপক দেশে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব রাখে এবং প্রযুক্তি, দক্ষতা ধারণা নিয়ে আসে এমন দেশের সহযোগিতা নেয়া সীমানা অতিক্রম করতে দেয়া উচিত। আন্তর্জাতিক অর্থের এমন জিনকে বোতলে ভরে রাখা যাবে না, কিন্তু উদীয়মান অর্থনীতি, মূলধন প্রবাহকে সীমাবদ্ধ করতে পারে। এটি স্থানীয় নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ওপর নির্ভর করে। কারণ ডলারের আধিপত্যের প্রভাব মার্কিনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর্থিক বিশ্বায়নকে আঁকড়ে ধরে পরে পস্তালে অভিযোগ করে লাভ হবে না।

আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, বিশ্ববাসী মনে হয় ভুলে গিয়েছে, গত চার দশকের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটগুলোর জন্য দায়ী অতিরিক্ত অর্থায়ন এর থেকে পুঁজিবাদকে অবশ্যই বাঁচাতে হবে। এজন্য আর্থিক বিশ্বায়নের দিকে ঝোঁকা ভালো উপায় নয়। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ব্রেটন উডসের স্থপতি জন মেনার্ড কেইনস একবার বলেছিলেন, ধারণা, জ্ঞান বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসারে, অর্থ ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে জাতীয় হওয়া উচিত। এখনই সময় আমাদের তার পরামর্শে মনোযোগ দেয়া।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান: ব্রাউন ইউনিভার্সিটির

সিনিয়র ফেলো এবং অব কাউন্সেল: দ্য চ্যালেঞ্জেস
অব দ্য মোদি-জেটলি ইকোনমি (ইন্ডিয়া ভাইকিং, ২০১৮)-এর লেখক

ভাষান্তর: পাপলু রহমান

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন