রিজার্ভের যে অবস্থা, ঝুঁকি নিতে পারি না: উপদেষ্টা তৌফিক

“আপনারা সমর্থন করলে দিনের বেলা পুরোটা সময় লোড শেডিং হতে পারে, রাতে বিদ্যুৎ পাবেন,“ ব্যবসায়ীদের বললেন উপদেষ্টা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2022, 03:29 PM
Updated : 23 Oct 2022, 03:29 PM

শিল্পোদ্যোক্তারা চাইলেন, তারা দাম বাড়িয়ে দেবেন, তবুও যেন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়; তবে তাদের হতাশ হতে হল। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা বললেন, বর্তমানে রিজার্ভে যে টান পড়েছে, তাতে বাড়তি দামে জ্বালানি আমদানির অবস্থা নেই।

বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানির বিশ্ববাজারে অস্থিরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। জ্বালানির উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশ দিতে হওয়ায় লোড শেডিং দিন দিন বাড়ছে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সঙ্কটে শিল্পোৎপাদন কীভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তা রোববার এক সভায় তুলে ধরেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলেন, গত এক মাসে ২২টি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ২৭টি রয়েছে বন্ধ হওয়ার পথে।

অতিরিক্ত দরে হলেও জ্বালানি আমদানির দাবি করেন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা।

শিল্প খাতে জ্বালানি সঙ্কটের প্রভাব নিয়ে ঢাকার একটি হোটেলে এই সভা আয়োজন করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ড্রাস্টিজ (বিসিআই)।

দিনের ১২ ঘণ্টাই শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ থাকছে না জানিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “উৎপাদন একেবারে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। গাজীপুরে সকালে বিদ্যুৎ গেলে বিকাল ৫টায় আসছে। তাহলে শিল্প এলাকা থাকল কী করে?”

তিনি জরুরি ভিত্তিতে ৫০০ এমএমসিএফ গ্যাস কেনার চুক্তি করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখেন। আর ‘স্বল্পমেয়াদে’ দ্রুত পেতে ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস স্পট মার্কেট থেকে কিনতে বলেন।

এ পরিমাণ জ্বালানির নিশ্চয়তা পেলে আগামী এক বছর শিল্পে সমস্যা থাকবে না বলে মনে করেন খোকন। এতে যদি প্রতি ইউনিটে ৪-৫টাকা বেশি দরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস কিনতে হয়, তাতেও ব্যবসায়ীরা রাজি বলে জানান তিনি।

তার এমন প্রস্তাব সমর্থন করে সভায় বক্তব্য রাখেন অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।

মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই সময়ে জ্বালানির উপর ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ ভ্যাট ও কর আরোপ করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।”

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতি স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘‘গত দুই মাসে ২৭টি কারখানা পরিদর্শন করেছি। তারা ভয়ে আছেন কখন বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশবান্ধব অনেক মেশিনারিজ ব্যবহার করা যাচ্ছে না গ্যাস সঙ্কটে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।”

সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “দাম বাড়িয়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব ইতোপূর্বে এফবিসিসিআই দিয়েছিল। এখন আমরা চাই, দাম বাড়ালে যেন সরবরাহ ঠিক থাকে। করোনা মহামারীর মতো যদি এই দুর্যোগে ব্যবসায়ীদের সহায়তা না করা হয়, তাহলে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যাংকও ডুববে।”

ব্যবসায়ীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ-ই সাত্তার বলেন, “সরকার সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে জ্বালানির এই সমস্যা সমাধান করতে পারে। এটি করাই যায়।”

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনও সমর্থন জানিয়ে বলেন, “সাড়ে ৪ বিলিন ডলার অতিরিক্ত খরচ করা যেতে পারে। কিন্তু এই পরিমাণ খরচের ঝুঁকি নেওয়ার মতো রিজার্ভ আছে কি না, তা আমি স্পষ্ট জানি না।”

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, “এ পরিমাণ জ্বালানি ক্রয়ে প্রতি মাসে অন্তত ২০০ মিলিয়ন অতিরিক্ত ডলার লাগবে। ছয় মাসের হিসাবে তা ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

“কিন্তু আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, তাতে তো এই রিস্ক নিতে পারি না। আমি তো জানি না, সামনে কী হবে। ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ কতদিন চলবে, তা তো জানি না।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন (রিজার্ভ) এরই মধ্যে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, যে অঙ্ক ২০২০ সালে ছিল। মাঝে তা বেড়ে ২০২১ সালের অগাস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারেও পৌঁছেছিল।

নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি এমএমসিএফ এলএনজির বর্তমান দর ২৫ ডলার, তা আবার বেড়ে ৩০-৩২ ডলারে উঠে।

“২৫ ডলার হিসাবে অন্তত ৬ মাস এলএনজি কেনার মতো অবস্থা আছে কি না, জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বিকল্প উপায়ে যেতে হবে।”

সম্ভাব্য বিকল্প উপায় নিয়ে তিনি বলেন, বাকিতে জ্বালানি পেতে মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তাব নিয়ে যাবে সরাকারের একটি প্রতিনিধি দল।

জ্বালানির দাম পরবর্তীতে পরিশোধ করতে অর্থাৎ এলসি (ঋণপত্র) এর দায় ‘ডেফার্ড’ করে জ্বালানি আমাদানি করা যায় কি না, তাও ভাবা হচ্ছে।

ভোলা থেকে গ্যাস আগামী ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে বার্জের মাধ্যমে ঢাকায় আনতে পারলে ৮০ এমএমসিএফ জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হবে, এমন কথাও বলেন উপদেষ্টা।

সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস, এলপিজি নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে চাইলে সরকার আপত্তি করবেনা বলেও জানান তিনি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা যখন এমন কথা বলছিলেন, তার মাঝেই এক ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বলতে আহ্বান জানান। তাকে সমর্থন দেন উপস্থিত ব্যবসায়ীরাও।

নিজের বক্তব্য থামিয়ে ওই ব্যবসায়ীর কথা শোনার পর তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, “আপনারা সমর্থন করলে দিনের বেলা পুরোটা সময় লোড শেডিং হতে পারে। রাতে বিদ্যুৎ পাবেন। এত আরাম-আয়েশ না করলেও চলবে। এসির ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে ভালো, নইলে ব্যবহার কমিয়ে দেন।”

আগামী ডিসেম্বরে মধ্যে কয়লাভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলে তখন বিদ্যুতে সরবরাহ কমিয়ে কিছু গ্যাস শিল্পে দেওয়া যাবে বলে আশা দেখান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা।

বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, “আমরা একটি চাপের মুখে আছি ডলার নিয়ে। দীর্ঘ দিন ধরেই পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে গ্যাসের দর সমন্বয় করেনি। এটা করা যায় কি না? ভেবে দেখা যেতে পারে।”

এই সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন।