ফিরে দেখা: ২০১৩ সালের রাজনীতি

bangladesh violance
ছবির ক্যাপশান, ২০১৩ সালের একটি বড় সময় বাংলাদেশের রাজপথ ছিল অশান্ত।

বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল একটি বছর ছিল ২০১৩। সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে নির্বাচনকে ঘিরে বছর জুড়েই উত্তপ্ত ছিল রাজনীতির মাঠ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দন্ড দেয়া হয়েছে ৯ জনকে। যাদের মধ্যে একজনের ফাঁসি্ও কার্যকর হয়েছে কিছুদিন আগেই।

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে্ও সরব আন্দোলন ছিল বছরজুড়ে।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবী নিয়ে বিরোধীদলের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ২০১৩ সাল।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে মানুষের মাঝে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা ছিল বছর জুড়ে। যে অস্থিরতার অবসান বছরের শেষে এসেও হয়নি।

কাদের মোল্লার রায় এবং গণজাগরণ মঞ্চ

তবে বছরের শুরুতে বড় ঘটনাটি ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই প্রথম জামায়াতের কোন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে দেয়া রায়।

৫ই ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দন্ডের প্রতিবাদে সন্ধ্যা থেকেই তার ফাঁসির দাবী নিয়ে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে মানুষজন জড়ো হতে শুরু করে।

shahbagh 2013
ছবির ক্যাপশান, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের চতুর্থ দিন। (ফাইল ফটো)

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবী নিয়ে এ আন্দোলনটিতে মানুষের উপস্থিতি হাজার ছাড়িয়ে বেশ কয়েকবার পৌছায় লক্ষ মানুষের সমাবেশে। পরবর্তীতে গণজাগরণ মঞ্চ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ আন্দোলনটি বাংলাদেশের নানা জেলাশহরেও ছড়িয়ে পড়ে ।

গণজাগরণ মঞ্চের এই আন্দোলনকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে পরবর্তী কয়েক মাস। তবে এরই মাঝে আসে ট্রাইবুনালের অপর একটি রায়।

দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়

২৮শে ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পরবর্তী কয়েকটি দিন ছিল ২০১৩ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে সহিংস একটি সময়।

দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পরবর্তী দু’দিনেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যমের হিসেবে সহিংতায় নিহত হয় প্রায় ৫০ জন। যাদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও রয়েছে।

প্রথমদিন বগুড়া, গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলীয় বেশ কয়েকটি জেলায় সহিংসতা শুরু হয়। এছাড়া্ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় রাস্তায় গাছ ফেলে বন্ধ করে দেয়া হয় চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক। টানা সপ্তাহখানেক বন্ধ থাকে কক্সবাজারের সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ।

হেফাজতে ইসলাম

sayeedee
ছবির ক্যাপশান, জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী।

এরই মধ্যে মার্চ থেকেই উথ্থান ঘটে একটি নতুন সংগঠনের। মূলত: ক্ওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

যদিও নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থনের কথা বলেনি হেফাজতে ইসলাম, তবে তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবেই ছিল শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে।

শাহবাগে নাস্তিকদের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চ চলছে, এমন একটি অভিযোগে ইসলাম রক্ষাসহ ১৩ দফা দাবীতে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয় হেফাজতে ইসলাম।

৫ই মে ২০১৩, সকাল থেকেই ঢাকায় ঢোকার পথগুলো অবরোধ করে রেখেছে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরা।এর আগে কয়েকদিন ধরেই ঢাকার বাইরে থেকে হাজার-হাজার হেফাজত সমর্থকেরা জড়ো হয়েছেন ঢাকায়।

সেদিন দুপুর নগাদ তারা জড়ো হতে থাকেন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। লক্ষাধিক কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিতে চলতে থাকে হেফাজতের সমাবেশ। আর একইসাথে দিনভর চলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ।

পরে হেফাজত নেতারা শাপলা চত্বরে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন।

রাত ১২ টার কিছু পরে পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে শুরু হয় অভিযান।

hefazot islam
ছবির ক্যাপশান, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ । (ফাইল ফটো)

সাউন্ড গ্রেনেড এবং ফাঁকা গুলির শব্দে আতংকিত অবস্থানকারীরা পালিয়ে যেতে শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় শাপলা চত্বর।

পুলিশ দাবী করে, ৫ এবং ৬ইমে শাপলা চত্বর ঘিরে অভিযানে মোট ১১ জন নিহত হয়।

যদিও হেফাজতে ইসলাম প্রাথমিকভাবে তাদের কয়েক’শ কর্মীর মৃত্যুর দাবী করে। পরবর্তীতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ঐ সহিংসতায় ৬১ জন নিহতের একটি তালিকা তৈরী করেছিল, তবে সেই তালিকা প্রকাশিত হয়নি এবং সেটি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করাও সম্ভব হয়নি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়

বছরজুড়ে বিভিন্ন সময়ে আরো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরো ৭ জনের দন্ড দেয়া হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির নেতারা।

৯ই মে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

১৫ই জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

১৭ই জুলাই বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

১লা অক্টোবর হত্যা, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়।

gholam azam
ছবির ক্যাপশান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেয়া হচ্ছে জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আজমকে।

৯ই অক্টোবর বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমেকে আমৃত্যু কারাদন্ড প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে তার বয়স বিবেবচনায় নেয়া হয়েছিল।

৩রা নভেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার দায়ে চৌধুরী মঈন উদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এদের দুজনেই দীর্ঘদিন যাবত বিদেশে অবস্থান করছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন

যুদ্ধাপরাধের ইস্যুর সাথে সারাবছরই রাজপথ উত্তপ্ত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোটের আন্দোলনে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ নানা ইস্যুতে বেশ কয়েক দফা হরতাল হয়েছে, হয়েছে অবরোধ। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা্ও গ্রেপ্তার হয়েছেন বেশ কয়েকবার।

তবে নির্দলীয় সরকারের দাবীতে বিএপির আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে বছরের শেষে এসে। মূলত: ২৫শে অক্টোবরের পর থেকে, সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামীলীগ সরকারের মেয়াদ শেষ ৯০ দিনে পৌছানোর পর থেকে ।

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝেই চলতে থাকে বিরোধী দলের হরতাল। তবে সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনের অবস্থানে অনড় থাকে সরকার। দুই দলের মধ্যে সংলাপ নিয়ে অনেক জ্বল্পনা-কল্পনা হলে্ও প্রকাশ্য কোন আলোচনা দেখা যায়নি।

নির্বাচনী তফসিল

নভেম্বরের মাঝামাঝি গঠিত হয় আওয়ামীলীগ এবং জাতীয় পার্টিসহ সরকারের শরীক দলগুলোর অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন একটি মন্ত্রীসভা। আর ২৫শে নভেম্বর ঘোষণা করা হয় নির্বাচনী তফসিল। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারন করা হয় ৫ই জানুয়ারী, ২০১৪।

hartal
ছবির ক্যাপশান, বিএনপির একটি হরতাল মিছিল। (ফাইল ফটো)

এরপর থেকেই শুরু হয় বিরোধী জোটের টানা অবরোধ।কয়েক সপ্তাহ ধরে শুধুমাত্র সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া অবরোধ চলে প্রতিদিন।

নির্দলীয় সরকারের দাবীতে বিরোধী জোটের আন্দোলনে এতদিন খুব একটা সহিংসতা দেখা না গেলেও, এই অবরোধকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নাশকতা দেখা যায়।

বাসে দেয়া আগুনে পুড়ে মারা যায় অন্তত ১০ জন। ব্যাহত হয় সারাদেশের রেল এবং সড়ক যোগাযোগ। এই অবরোধ অব্যাহত থেকেছে বছরের শেষপর্যন্ত।

কাদের মোল্লার ফাঁসি

বছরের শুরুটা যেমন হয়েছিল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ঘিরে একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে, বছর শেষেও উত্তাপ ছড়িয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসি।

১২ই ডিসেম্বর এই ফাঁসির মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই প্রথম কোন দন্ড কার্যকর হলো।

রাজনৈতিক অঙ্গনে একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে, বছরটি শেষও হচ্ছে রাজনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই।.